সারুসাজাই স্পোর্টস কমপ্লেক্সের জাকির হুসেন সুইমিংপুলের টাচ প্যাডটা ছুঁতেই মাইকে এল ঘোষণা। সঞ্চালকের উচ্ছ্বসিত উচ্চারণ, ‘এবারের গেমসে রেকর্ড গড়ে সাঁতারে সোনা জিতলেন বাংলাদেশের মাহফুজা খাতুন।’
বাবা শখ করে নাম রেখেছিলেন শিলা। কঠিন শিলার মতোই যেন ভেতরে জমানো ছিল আগুন। বারবার ফেডারেশনের বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। ক্ষোভের পাথরে ঘষা লেগে সেটি এবারের দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে এমনভাবেই জ্বলে উঠল যে সেই আলোয় আলোকিত সারা বাংলাদেশ।
সাঁতারে মেয়েদের ৫০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে কাল এসএ গেমসের রেকর্ড গড়ে সোনা জিতেছেন মাহফুজা। তিনি সময় নেন ৩৪.৮৮ সেকেন্ড। নিজের প্রিয়তম ইভেন্টের ফাইনালে সাঁতরানোর আগে হিটে সময় নেন আরও কম—৩৪.৬৬ সেকেন্ড! নিশ্চিত সোনা জয়ের স্বপ্নে বিভোর মাহফুজা ফাইনালে মাত্র সেকেন্ডের এক-পঞ্চমাংশ বেশি সময় নিয়েছেন। কারণ, ‘নার্ভাস লাগছিল খুব!’ কিন্তু এতেও মাহফুজা ভেঙেছেন দক্ষিণ এশিয়ার ১০ বছরের পুরোনো রেকর্ড। ২০০৬ শ্রীলঙ্কা গেমসে এই ইভেন্টে ৩৪.৯৭ সেকেন্ড সময় নিয়ে সোনা জেতেন শ্রীলঙ্কার রাহিম মায়ুমি।
গত পরশু ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে প্রথম সোনা জিতেই বাংলাদেশের সাঁতারে ইতিহাস গড়েছিলেন মাহফুজা—গেমসে সোনাজয়ী বাংলাদেশের প্রথম নারী সাঁতারু তিনি। কাল টানা দ্বিতীয় সোনা জিতে নিজেকে নিয়ে গেলেন অনন্য উচ্চতায়। গত এসএ গেমসে সাঁতারে ৭টি রুপা ও ৮টি ব্রোঞ্জ পদকের মধ্যে ১০০ ও ৫০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে রুপা জিতেছিলেন। ঘরোয়া টুর্নামেন্টেও সাফল্য পেয়ে আসছিলেন নিয়মিত। গোপালগঞ্জে হওয়া সর্বশেষ জাতীয় সাঁতারে এসএ গেমসের রেকর্ড টাইমিং টপকেছিলেন। তারপরও তাঁকে বাদ দিয়ে অলিম্পিকে পাঠানো হয় অন্যদের। বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণে গেছেন তাঁরই সতীর্থরা। মাহফুজা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতেন। আর হয়তো আক্ষেপ করতেন, ‘আর কত বড় হব দাদাঠাকুর...?’
এবারের গেমসের আগেও অনেক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘শিলা তো বুড়িয়ে গেছে। ওকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না’, তাচ্ছিল্যভরে মাহফুজাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছেন, ‘এবার তো ওকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ভারতে নিয়ে আসা হয়েছে।’ টাইমিংয়ের উন্নতিকে কখনোই মানদণ্ড ধরেনি ফেডারেশন, শুধু জাতীয় সাঁতারে সর্বাধিক সোনা জিতলে তাঁকেই বিদেশে পাঠানো হতো। হতাশায় সাঁতারটা একসময় ছেড়েই দিতে চেয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার ছাত্রী। সব ছেড়ে পড়াশোনায় মন দিতে চলে গিয়েছিলেন চট্টগ্রামে। গেমসের প্রাথমিক অনুশীলন ক্যাম্পেও তাঁর জায়গা হয়নি! কোরিয়ান কোচ পার্ক তে গুন এসে অবশ্য প্রথমেই খুঁজেছেন মাহফুজাকে। ক্যাম্পে তাঁকে না পেয়ে চট্টগ্রাম থেকে ডেকে নিয়ে আসেন। যশোরের নওয়াপাড়ার মেয়েটি ফেডারেশনের এমন বৈষম্য আর উপেক্ষার জবাব দিলেন সাঁতারপুলের নীল জলে নেমে। মাহফুজার হাতে ধরা সোনার পদকের ঔজ্জ্বল্যে মিশছিল যেন তাঁর চোখের আগুন, ‘কোচ পার্ক আমাকে অনেক সাপোর্ট করেছেন। উনি না থাকলে হয়তো আমি এখানে আসতেই পারতাম না। আর সাপোর্ট পেয়েছি নৌবাহিনীর। বৈষম্যের কারণে সুইমিংজগৎ থেকে চলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু পার্ক এসে বুঝিয়েছেন, তোমাকে দিয়েই কিছু হবে। বলেছেন, তুমি ফেডারেশনের কথা না ভেবে দেশের কথা ভাবো। তাই আমি দেশের জন্য সাঁতরেছি।’ এখন তাঁর বুকের জ্বালাটাও একটু জুড়াল, ‘যারা বলেছিল আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না, তাদের মনে হয় একটা পাল্টা জবাব দিতে পেরেছি।’
মাহফুজাকে ‘আবিষ্কার’ করেন সাঁতার দলের বর্তমান ম্যানেজার আবদুল মান্নান। শিশু একাডেমিতে অ্যাথলেটিকস ও সাঁতারে চ্যাম্পিয়ন হওয়া ছোট্ট মাহফুজার প্রতিভার কথা শুনেছিলেন একজন ফুটবল রেফারির কাছে। কিন্তু মাহফুজার ঠিকানা তাঁর জানা ছিল না। প্রায় চার মাস ধরে গোটা যশোরে তন্ন তন্ন করে খুঁজে পেয়ে নিজের বাড়িতেই রাখেন তাঁকে। পরে অনুশীলন করান যশোরের ডলফিন সুইমিং ক্লাবে। মান্নান চাকরি করতেন খুলনায়। এ জন্য কখনো যশোরের শিশু এতিমখানাতেও থাকতে হয়েছে মাহফুজাকে। পরে ঢাকায় শিশু একাডেমি ও আন্তজেলা মহিলা সাঁতারে চ্যাম্পিয়ন হওয়া মাহফুজাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বিকেএসপিতে ভর্তির সুযোগ পান ২০০৩ সালে। কাল সোনা জয়ের পর মাহফুজার মতোই আনন্দে আত্মহারা আবদুল মান্নান, ‘আজ আমার চেয়ে সুখী আর কেউ নেই।’
ঘরে-বাইরে সবখানে লড়াই করতে হচ্ছে মেয়েদের। তবু সব প্রতিকূলতা জয় করে যে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়, সেটির সবচেয়ে বড় উদাহরণ মাহফুজা।
দক্ষিণ এশিয়ার সীমানা ছাড়িয়ে মাহফুজার চোখে এখন অলিম্পিকের স্বপ্ন, ‘আমি এবার অলিম্পিকে খেলতে চাই।’
সেই স্বপ্ন পূরণের পথে ফেডারেশন কি আবারও বিছিয়ে দেবে অদৃশ্য কোনো কাঁটা!
No comments:
Post a Comment